বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিয়ানা EKK students jara ei page e achhe tader gyatarthe
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি, জানতেন চৌত্রিশটি ভাষা । মারা গেলেন ও ঠিক চৌত্রিশ বছর বয়সে । আজ তাঁর জন্মদিন, আমরা কেউ মনে রাখিনি ।
ক্ষণজন্মা এক বাঙালি ..... 🏵️🏵️
লেখক- স্বপন সেন
===========================
সে এক অদ্ভুত ছেলে ......
চার বছর বয়সও তখন হয় নি , বাবা প্রথম ভাগের বই এনে দিয়েছিলেন। ছেলের আর সবুর সয় না, বইটা পড়ার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। রান্না ঘরে কাজে ব্যস্ত মা এলোকেশী ছেলের পীড়াপীড়িতে গোটা বইটা একবার ছেলেকে পড়িয়ে দিলেন। সন্ধেবেলা বাবা বাড়ি ফিরে এলে ছেলেটি তার হাতে বই তুলে দিয়ে গড়গড় করে আগাগোড়া মুখস্থ বলে গেল। শুধু তা-ই নয়, স্লেটের উপর অ,আ,ক,খ, সবগুলি অক্ষর অনায়াসে লিখে ফেলল। বাবার তো বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া !
সবাইকে চমকে দেওয়া এই অসাধারণ মেধাবী ছেলেটিই হলেন পরবর্তীকালের পৃথিবী বিখ্যাত ভাষাবিদ হরিনাথ দে।
বিখ্যাত রাশিয়ান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ কোরবাভস্কি কলকাতায় এসে হরিনাথের সঙ্গে আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে হরিনাথকে সেন্ট পিটাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পদ গ্রহন করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। রাশিয়ান এবং সংস্কৃত ভাষায় গভীর জ্ঞান এবং বৌদ্ধ দর্শনে হরিনাথের অসাধারণ পাণ্ডিত্য কোরবাভস্কিকে বিস্মিত করেছিল। সুপরিচিত জাপানি পণ্ডিত ওটানি কোজুই হরিনাথের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অনেকগুলি প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য পুঁথি উপহার দেন। প্রখ্যাত জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ রিচার্ড ফন পিশেল হরিনাথের পাণ্ডিত্যের কথা শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদ ও সংস্কৃতের ওপর তিনি বক্তৃতা দেন।
১৮৭৭ সালে আজকের দিনে (১২ই আগষ্ট)
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে আড়িয়াদহে জন্মগ্রহণ করেন হরিনাথ। পিতা রায়বাহাদুর ভূতনাথ দে ছিলেন মধ্যপ্রদেশের প্রখ্যাত আইনজীবি । রায়পুরের সরকারি মিডল ইংলিশ স্কুলে শুরু হয় শিক্ষাজীবন। ১৮৯৬ সনে লাতিন ও ইংরেজিতে ডাবল অনার্স সহ কৃতিত্বের সঙ্গে বি-এ পাশ করে স্কলারশিপ পান। একই বছরে লাতিন ভাষা ও সাহিত্যে শতকরা ৭৭ ভাগ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম-এ পাশ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপোস-এর দুর্লভ সম্মান অর্জন হরিনাথের শিক্ষা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা।
ইউরোপের বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপকদের কাছে হরিনাথ পাঠগ্রহন করেন। বিভিন্ন ভাষায় হরিনাথের অসাধারণ কৃতিত্ব ও বিস্ময়কর প্রতিভা বিদেশী অধ্যাপকদের চমৎকৃত করে। গ্রিক, লাতিন, মধ্যযুগীয় জার্মান ভাষা, মধ্যযুগীয় ফরাসি ভাষা, আধুনিক জার্মান ও ফরাসি, ইতালিয়ান স্পেনিস ও পর্তুগিজ প্রভৃতি প্রাচীন ও ইউরোপীয় ভাষায় হরিনাথের বিশেষ দখল ছিল। জানতেন পাঁচটি নয়, ছটি নয় মোট চৌত্রিশ টি ভাষা... তারমধ্যে ১৮টিতে স্নাতকোত্তর (M.A) ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। কি বিস্ময়কর প্রতিভা ভাবুন একবার ! আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন শুধু চীনা ভাষাটাতেই দাঁত ফোটাতে পারলাম না ।
ইউরোপ ভ্রমণে গেছেন ভ্যাটিকান সিটি। পোপ দশম পিউসের সামনে হরিনাথ, চোস্ত লাতিন ভাষায় অভিবাদন জানালেন বাঙালি যুবক। চোখা চোখা লাতিন উচ্চারণে স্তম্ভিত পোপ। পরামর্শ দিলেন, এ বার ইতালীয়টাও শিখে ফেললে হয় তো!
পোপকে স্তম্ভিত করে দিয়ে হরিনাথ এর পর তাঁর সঙ্গে সরাসরি ইতালীয়তেই কথা বলতে শুরু করে দিলেন!
হরিনাথের ল্যাটিন-দক্ষতা চমকে দিয়েছিল লর্ড কার্জনকে। আরবি ও পার্সি থেকে অনুবাদ করে তিনি সাহেবকে একটি বই উপহার দেন। বইটির উৎসর্গ পত্রটি ছিল ল্যাটিনে লেখা। তাতে এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন কার্জন, যে ঢাকায় গিয়ে তিনি ডেকে পাঠান হরিনাথকে। তিনি তখন ঢাকার এক কলেজের অধ্যাপক।
তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রাপ্ত স্বর্ণপদক, পুরস্কার ও স্কলারশিপের তালিকাও বেশ লম্বা। ইউরোপে শিক্ষামূলক ভ্রমণের সময় ভারত তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন।১৯০৫ সালে হরিনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলি ভাষা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচয়িতা ও পরীক্ষক ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে হরিনাথ অনেক গ্রন্থাদি রচনা করেন। অধ্যাপনা করছেন কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছিলেন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর (বর্তমানে National Library) প্রথম ভারতীয় লাইব্রেরীয়ান ।
বিস্ময়কর প্রতিভা সম্পন্ন এই বঙ্গসন্তান মাত্র চৌত্রিশ বছরে টাইফয়েডে ইহলোক ত্যাগ করেন । আজকাল মহা ধুমধাম করে চারিদিকে ভাষা দিবস পালিত হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বাঙালী ভাষাবিদকে কেউ মনে রাখিনি । কে জানে হয়তো বাঙালি বলেই । জন্মদিনে লহ প্রণাম 🌹🌹
লেখক- স্বপন সেন Swapan Sen
ঋণস্বীকার : বিস্মৃত ভাষাবিদ্ হরিনাথ দে (সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়), আচার্য হরিনাথ (অঘোরনাথ ঘোষ) ... See more