গত ১৩ ই জুন, ‘এসো কিছু করি’ আয়োজন করেছিল ‘হৃদমাঝারে’ নামে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের, সম্পূর্ণভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।
সদ্য হয়ে যাওয়া আমফান ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপে আজ অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের খাদ্য, এমনকি পর্যাপ্ত পানীয় জলেরও সংস্থান নেই। এই অবস্থায় সরকারের ত্রাণকার্যের সাথে সাথেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও নেমে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে। “এসো কিছু করি”-র বহু বর্তমান আর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা তাদের নিয়মিত খবর নিচ্ছি। সদস্য – স্বেচ্ছাসেবকরা মিলে কিছু টাকাও তুলেছি। যাদের বাড়ি ভেঙে গেছে তারা যাতে অন্তত তাদের বাসস্থান টা সুরক্ষিত করতে পারে সেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রয়োজন ছিল আরও বড় মাপের কিছু করার৷ করোনার সময় সকলেই ঘরবন্দী। এই অবস্থায় কী করা যায়, সেই ভাবনার মধ্যেই জার্মানি-প্রবাসী দীপ আর সংহিতার কাছ থেকে প্রস্তাব আসে অনলাইনে একটা fund raising অনুষ্ঠান করার। দীপ, সংহিতা এবং “এসো কিছু করি” -র সদস্য, স্বেচ্ছাসেবক, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, আয়োজন, প্রচার আর টিকিট বিক্রিতে। সঙ্গে এগিয়ে আসেন সম-মনস্ক আরও কিছু সংস্থা যাঁরা এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।
১৩-ই জুন ভারতীয় সময় রাত ন’টায় এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই প্রচেষ্টায় প্রযুক্তিগত সহায়তা করেছেন বেঙ্গল ওয়েব সলিউশন । দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ যারা টিকিট কেটে রেখেছিলেন তারা নিজের নিজের বাড়িতে আসন গ্রহণ করেন। সকলের কম্পিউটার বা মোবাইলে ভেসে ওঠে হৃদয়, লক্ষ্মী, তরুণ সহ এই সংস্থার একঝাঁক পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের ছবি। তারা জানায় কিভাবে “এসো কিছু করি” তাদের প্রয়োজনের সময়ে পাশে থেকেছে আর আজ তারা কিভাবে “এসো কিছু করি”- র পাশে থাকছে। যথাযথ সময়ে স্টেজ থেকে পর্দা ওঠে। সঞ্চালক সুজয়নীলের ভরাট কন্ঠস্বর সবাইকে স্বাগত জানায়। আলাপচারিতা শুরু হয় এই অনুষ্ঠানের অন্যতম সংগঠক দীপ নাগ আর ” এসো কিছু করি”- র সভাপতি মধুমিতা দত্তের সাথে। দীপ জানায় সূদুর জার্মানিতে বসে কিভাবে এইরকম একটা অনুষ্ঠানের কথা তার মাথায় আসে। মধুমিতাদি জানায় EKK -র শুরুর দিনের কথা। আজ আমফানে আমাদের যেসব ছাত্রছাত্রীদের ঘরের চাল উড়ে গেছে, সমস্ত আসবাবের সাথে পড়ার বইগুলোও ভিজে পাতা ফুলে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত আর তাই পুরো team EKK এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এরপর অনুষ্ঠান শুরু হয় দেবপ্রিয়া চক্রবর্তীর গলায় “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো” গান দিয়ে। অনুষ্ঠানের নামের সাথে সঙ্গতি রেখে এটাই ছিল উদ্বোধনী সঙ্গীত আর তারপরেই উনি গাইলেন “আগুনের পরশমণি”, যে গান গেয়ে “এসো কিছু করি”- র সমস্ত অনুষ্ঠান শুরু হয়। দেবপ্রিয়ার গান এই অনুষ্ঠানের তার টা বেঁধে দেয়। মূল পর্বের অনুষ্ঠানে প্রথম অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও বাচিক শিল্পী শ্রী সৌমিত্র মিত্র। বাংলা থিয়েটারের বিবর্তন, ঘরবন্দী সময়ে পড়া কিছু বই, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদির সমন্বয়ে একটা মনোগ্রাহী কথোপকথন হয় যা দর্শকদের সমৃদ্ধ করে। নানা অজানা কথা আমরা জানতে পারি। যেমন, একবার বেড়াতে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশক বন্ধু ইন্দ্রনাথ বীরভূমের জঙ্গলে হারিয়ে যান, তিন দিন পর্যন্ত তার কোনও খোঁজ ছিল না। সেই খোঁজ আর ইন্দ্র নামের প্রতিধ্বনি নিয়েই শক্তি একটি বিখ্যাত কবিতা লিখে ফেলেন।
অনুষ্ঠানের পরবর্তী পর্যায়ে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান কুমকুম বাগচি। দেশ, পূজা আর প্রেম পর্যায়ের তিনটি গান দর্শকরা খুবই উপভোগ করেন।
এরপরে মঞ্চে আসেন জগন্নাথ বসু এবং ঊর্মিমালা বসু। ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই ওনাদের শ্রুতিনাটক শুনে বড় হয়েছি। আকাশবাণীর স্বর্ণযুগে যে কন্ঠ যাদু জাগাতো আবারও সেই কন্ঠস্বর মুগ্ধ করলো আমাদের। এই সময় কিভাবে কাটাচ্ছেন সেই নিয়ে কথা শুরু হল। বয়সের কারণে এখন সরাসরি দুর্গতদের পাশে যেতে না পারলেও এরকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবসময় আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার কথা জানালেন ওনারা। জগন্নাথ বাবুর মুখে শুনলাম মিউনিখের বরফ আর রানাঘাটের পান্তুয়ার কথা৷ দু’জনেই এই সময়ের উপযোগী একটা করে কবিতা আবৃত্তি করলেন। তারপরে শোনালেন শ্রুতিনাটক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা “ইকেবানা”। শ্রুতিনাটক কিভাবে পড়াশুনোর সুযোগ না পাওয়া অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের কাছে সাহিত্যের স্বাদ পৌঁছে দিয়েছে আলোচনায় উঠে এলো সেই কথাও৷

অনুষ্ঠানে পরের অতিথি ছিলেন গবেষক এবং সমাজকর্মী ডক্টর দুর্বা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমফান রিলিফের জন্য সুন্দরবনে গিয়ে ওনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন তিনি। এর মধ্যে শোনালেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ আর শ্রীজাত র লেখা তিনটি কবিতা।
এরপর মঞ্চে আসেন গায়িকা সায়নী পালিত। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর ছাত্রী, বর্তমানে হিন্দি ও বাংলা ছবির প্লেব্যাক সিঙ্গার সায়নী কিন্তু নিজের একটাও গান না গেয়ে অনুষ্ঠানের আবহকে ধরে মান্না দে-র গান দিয়ে শুরু করলেন। সমগ্র দর্শকমণ্ডলীকে সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে দিয়ে শেষ করলেন আশা-র কথা শুনিয়ে। “যতই বড় হোক রাত্রি কালো, জানবে ততই কাছে ভোরেরও আলো।” আশা ভোঁসলের গাওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় “তোলো ছিন্নবিনা…” যেন আমাদের লড়ার ভাবনাকেই প্রতিফলিত করছিল।
একদম শেষ পর্বে একটা আড্ডা হয় সমাজের বিশিষ্ট তিনজন ব্যক্তিত্বের সাথে। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক, সমাজসেবী ও নাট্যকর্মী ডক্টর অর্জুন দাশগুপ্ত। তাঁর সাথেই ছিলেন এ’সময়কার ব্যস্ততম চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, নাট্যকর্মী, সঞ্চালক পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। আরও ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক ও নাট্যকর্মী দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। এই পুরো আড্ডাটাই যেন এই সময়ের দলিল হয়ে থেকে গেল। এই গৃহবন্দী অবস্থাও কিন্তু কারুর সৃজনশীলতাকে আটকে রাখতে পারেনি। পদ্মনাভ লিখে ফেলেছেন একটা গোটা উপন্যাস এই সময়ের ওপরে। দেবেশও জানালেন যে ছোটদের জন্য একটা বই লিখেছেন আর সাতটা স্বল্প দৈর্ঘের ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। এছাড়াও পুরোনো হারিয়ে যাওয়া অনেক থিয়েটার আর যাত্রার ডকুমেন্টেশনের কাজেও হাত দিয়েছেন। ডাক্তার অর্জুন দাশগুপ্ত এর মধ্যে ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে। সবার কথাতেই ছিল আশাবাদ। নতুন কাজ করতে হবে। এই সময় টাকে ধরে রাখতে হবে।
অনুষ্ঠান শেষ হয় সংগঠকদের সাথে একটা আলাপচারিতার মাধ্যমে। দীপ আর মধুমিতা দত্ত-র সাথে সেখানে উপস্থিত ছিল সংহিতা দত্তও যিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এই অনুষ্ঠান সফল করার জন্য। আর এদের কথার মধ্যে দিয়ে বারবার উঠে এসেছে আর একজন মানুষের নাম যিনি নিজেকে আড়ালে রাখতে চেয়েছেন কিন্তু এই সমগ্র আয়োজনটা তিনি না থাকলে হতই না। তিনি আমাদের সবার প্রিয় “এসো কিছু করি”-র ওঙ্কার দা।
এই অনুষ্ঠান থেকে আমরা কী পেলাম? একটা সুন্দর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা বা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো তো আছেই কিন্তু তার সাথেই এই কয়েক ঘন্টায় এই সময়ের একটা ডকুমেন্টেশন ধরা রইলো। এই অভূতপূর্ব সময়ে সমাজের বিভিন্ন মানুষ কী ভাবছেন কিভাবে লড়ছেন। সংস্থা হিসেবে “এসো কিছু করি” কী ভাবছে তা রেখে দেওয়া গেলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। একদিন আমরা এই ঝড় কাটিয়ে শান্ত পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াবো। তখনকার জন্য কিছু তথ্য বন্দী হয়ে রইলো এই অনুষ্ঠানের ভিডিওতে। দেশ-বিদেশের কত মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেলো যে এই অবস্থা আমরা কাটিয়ে উঠবোই। এই অনুষ্ঠানেই জগন্নাথ বসুর আবৃত্তি করা কবি রনজিৎ দাস এর লাইন ধার করে বলতে পারি “বিপন্ন বিস্ময় থেকে আমরা যেন পৌঁছে যেতে পারি বিশুদ্ধ বিস্ময়ে”।