‘এসো কিছু করি’-র প্রোজেক্ট মেধা পরিকল্পনার সময় আমাদের বেশকিছু ভাবনার মধ্যে একটা ছিল dropout আটকানো। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছিলো মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক এই সময়টার মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অথচ এরা যদি আর কয়েকটা বছর পড়াশুনোটা চালিয়ে যেতো তাহলে এদের জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেতে পারতো। শুধু নিজের জীবনই নয় এমনকি নিজেরা শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হয়ে এদের পারিপার্শ্বিকেও এরা একটা পরিবর্তন আনতে পারতো। এই observation টা মাথায় রেখে কাজ করতে নেমে গত দশ বছরে নিশ্চিতভাবে বেশ কিছু আর্থিকভাবে দুর্বল মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে ‘এসো কিছু করি’ dropout-এর হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে।
গত পয়লা এপ্রিল ঠিক এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম জয়কৃষ্ণপুরের বর্ণালী গড়াইয়ের বাড়িতে গিয়ে। আমাদের এবারের বাঁকুড়া স্টাডিট্যুরের শুরুটাই হল এই চুড়ান্ত sensitive একটা case দিয়ে। বর্ণালীরা দুই বোন দুই ভাই। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন একরাতের জ্বরে সঠিক ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে বর্ণালী তার মা-কে হারায়। এরপর দুই বোন মিলে সংসারের সব কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। কিন্তু গতবছর অকস্মাৎ বর্ণালীর দিদির ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরার পরে ওর পায়ের তলার মাটি সরে যায়। দিদিকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হয় কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে। প্রায় তিনমাস বর্ণালী হাসপাতালেই ছিল দিদির সঙ্গে। তারপর ফিরে এসে পরীক্ষা দিলেও ঘরের সমস্ত কাজ একা সামলে সামান্যই সময় ও পড়াশুনোর জন্য দিতে পেরেছে। দীর্ঘদিন স্কুলে না যেতে পারায় অনেক বিষয় বুঝতে এখুন খুবই অসুবিধে হচ্ছে। বাবা আর ঠাকুমাও চায় না ও পড়াশুনো করুক। তার চেয়ে বর্ণালীর বাড়ির কাজ করা এখুন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্র্যাডিশন মেনে দুই ভাই কোনো কাজ না করে পড়ায় মন দেয়। তারা পড়বে, চাকরি করবে। তাদের দিদি পড়াশুনোয় যতোই ভালো হোক সে সংসারের সব কাজ করবে তারপর তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। বর্ণালী চায় nursing পড়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু পরিস্থিতি তার আত্মবিশ্বাসে অনেকটাই চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম বর্ণালী আর ওর বাড়ির লোকেদের বোঝাতে কিন্তু আমাদের সময় সীমিত, দূরত্ব অনেক। ফোনে যোগাযোগ রেখে ভবিষ্যতেও যতটা সম্ভব এই চেষ্টা চালিয়ে যাব তবে লড়াই খুব কঠিন। এই মুহূর্তে ওদের রোজগারের কোনো মাধ্যম নেই। বাবা কলকাতায় থাকে দিদির চিকিৎসার জন্য। বাড়ি ভেঙ্গে পরার উপক্রম। তারই মধ্যে রান্না করে চলেছে বর্ণালী পাশে খোলা বই, দুচোখে স্বপ্ন একদিন নার্স হয়ে ওর দিদির মতো অসংখ্য রোগীর শুশ্রূষা করবে। ওর মায়ের মতন চিকিৎসার অভাবে অসময়ে চলে যেতে দেবেনা কাউকে।